
স্থানীয়দের বর্ণনায়, একসময় আয়তন ও দৈর্ঘ্যে বেশ বড় ছিল রাজধানীর মিরপুরের পশ্চিম অংশে অবস্থিত রূপনগর খাল। নৌকা চলতো নিয়মিত। খাল দিয়ে মানুষ তুরাগ নদী পর্যন্ত যেত। তবে কালে কালে দখলে আর দূষণে খালটি সংকীর্ণ হতে হতে বিলীন হওয়ার পথে।
খালের বিভিন্ন অংশ সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ভরাট করে দখল হয়ে গেছে। এ ছাড়া ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হতে হতে খালটি নালায় পরিণত হয়েছে। রূপনগর আবাসিক এলাকার ভেতর দিয়ে যাওয়া এই খাল এখন বিলীন হওয়ার পথে।
তবে আশার কথা হলো, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম খালটি পুনরুদ্ধারের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রূপনগর খাল দিয়ে আবারও নৌকা চলাচল করবে। খালের পাশে বড় ফুটপাতসহ রাস্তা নির্মাণ হবে। খালের পাশে মানুষের বসারও ব্যবস্থা রাখা হবে।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, মিরপুরের এই খাল মিরপুর কমার্স কলেজ-সংলগ্ন হাজি রোড থেকে শুরু হয়ে দ্বিগুণ চওড়া হয়ে তুরাগ নদীর সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত ছিল। কিন্তু বর্তমানে খালের সীমানা সড়ক থেকে বেশ দূরে সরে গেছে। অথচ একসময় মিরপুরের মধ্যে চলাচলের অন্যতম মাধ্যম ছিল এই খাল। আশপাশ যখন বসত গড়ে ওঠেনি, তখনও এই খালে নৌকায় চলাচল করতো মানুষ।
রূপনগর খাল গণপূর্ত অধিদফতরের অধীনে। প্রথমে খালটির দেখভালের দায়িত্ব ওয়াসাকে দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতি বছরের জরিপে খালের আকার কমতে থাকে। ওয়াসার দাবি, খালের সীমানা নির্ধারণ করে না দেওয়ায় এই অবস্থা হয়েছে।
পরে খালটি উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অধীনে দেওয়া হয়। এরপর খালের সীমানা নির্ধারণসহ খাল উদ্ধারে নামে ডিএনসিসি। এরইমধ্যে কয়েকবার খাল পরিষ্কার করা হলেও স্থানীয় বাসাবাড়ির ময়লাসহ লেপ-তোশক, নষ্ট ফ্রিজের মতো ভারী ময়লাও এই খালে ফেলে চলেছেন স্থানীয়রা। খালের পাড় দখল করে অবৈধ বাসাবাড়ি ও দোকান বানানো হয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, রূপনগর আবাসিক এলাকার পশ্চিম পাশে ২৩ নম্বর সড়কের কালভার্টের সামনে থেকে ৭ নম্বর সড়ক পর্যন্ত খালটি কংক্রিটের দেয়াল তুলে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। বাঁধের পাশেই মাটি ফেলে ৪০ ফুট রাস্তা বানানো হচ্ছে। যদিও এই রাস্তা বানানোর উদ্যোগ ২০১৭ সালেই নিয়েছিল ডিএনসিসি। তখন খালটি দেখভালের দায়িত্বে ছিল ঢাকা ওয়াসা। এই নির্মাণ নিয়ে সে সময় খোদ ওয়াসা থেকে আপত্তি জানিয়ে কাজ বন্ধ রাখা হয়। পরে খালের দায়িত্ব ডিএনসিসি পেলে ২০১৯ সালে ডিএনসিসির বিরুদ্ধে রূপনগর খাল দখল করে রাস্তা নির্মাণের অভিযোগ তোলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এ নিয়ে একটি মামলাও হয়েছে।
স্থানীয়, পরিবেশবাদী ও নগরবিদদের মতে, এই উন্নয়ন কার্যক্রমের কারণে খালটি ক্রমেই সরু হয়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া রূপনগর আবাসিক এলাকার ২৯ নম্বর সড়কের মোড়ে এসে খালটি ঝিলের আকার ছিল। সেখানে জাতীয় পরিকল্পনা ও উন্নয়ন অ্যাকাডেমির (এনএপিডি) ভবন তৈরি করা হয়েছে। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ থেকে কয়েকটি ব্যক্তিগত প্লটও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, রূপনগর খালের বড় সর্বনাশ হয়েছে আবাসিক এলাকার ৬ নম্বর সড়কের মাথায় খাল দখল করে ওয়াসার পাম্প স্থাপন এবং একটি আবাসিক প্রকল্প গড়ে ওঠায়। পানির পাম্পের কারণে খালটি একেবারেই সরু হয়ে যায়। পরে কিছু জায়গা ছাড়লেও এই পাম্পের পরেই রূপালী হাউজিংয়ের কারণে খাল হয়ে গিয়েছে দুই ফুটের ড্রেন। এই ড্রেন দিয়ে কোনোমতে পানি যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। রূপালী হাউজিংয়ের কারণে খালটি হারিয়েই গেছে।
রূপালী হাউজিংয়ের পরে দারুল আমান নামে আরেকটি হাউজিং কমার্স কলেজ-সংলগ্ন হাজি সড়ক থেকে নামা ৫০ ফুটের খালটির পুরোটাই দখল করে নিজস্ব সড়ক বানিয়ে ফেলেছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. তফাজ্জল হোসেন টেনু বলেন, রূপনগর খালের এক অংশে সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন খালটি রক্ষা করা সহজ হবে। আমি সবসময় সচেষ্ট থাকি যেন খালে কেউ ময়লা না ফেলে। তবু জনগণকে পুরোপুরি সচেতন করা যাচ্ছে না। তবে অনেক বস্তি ছিল খালের ওপর, সেগুলোর অনেকটাই সরানো সম্ভব হয়েছে। খালের বাকি অংশ আমার ওয়ার্ডে না পড়লেও আমি মনে করি খালে যেন কেউ ময়লা না ফেলে, সব কাউন্সিলরের তা দেখা উচিত।
ডিএনসিসির আঞ্চলিক অফিস ২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) মো. কামরুল হাসান বলেন, খালের মাপটি আমার জানা নেই এই মুহূর্তে। তবে খালের পাশে ৪০ ফুটের একটি দৃষ্টিনন্দন রাস্তা হবে। সেই রাস্তার কাজ চলছে। জুনের পর থেকে কাজ আরও দ্রুতগতিতে এগোবে।
তবে খাল সংস্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, এখন খাল সংস্কারের মতো বাজেট পাওয়া যায়নি। তবে খালের সীমানা নির্ধারণে সেনাবাহিনী কাজ করছে। খালটির সীমানা নির্ধারণ করা হলে তখন খাল সংস্কারে মনোযোগী হবো আমরা।
সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম রূপনগর খাল কয়েক দফা পরিদর্শন করেন। তখন তিনি ঘোষণা দেন, এই খাল দিয়ে নৌকা চলাচলের ব্যবস্থা করা হবে। অবৈধ যত দখল আছে, সব উচ্ছেদ করা হবে।
মেয়রের এই চ্যালেঞ্জকে স্বাগত জানিয়েছেন স্থানীয় জনগণ। তবে তা কঠিন বলেও মনে করেন তারা। তাদের প্রত্যাশা, তবু খালটি উদ্ধার হোক।
স্থানীয় রূপনগর আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ফরিদ আহমাদ বলেন, খালটি উদ্ধার হলে আমাদের জন্য বিনোদনের মতো একটি জায়গা হবে। রূপনগর খালের আরেকটি অংশ আছে মিরপুর আরামবাগের ভেতর দিয়ে। এই দুটি খাল উদ্ধার হলে আমরা স্থানীয়রা যেমন সুন্দর একটি খাল পাবো, এলাকার যে জলাবদ্ধতা আছে, তাও দূর হবে।