
নিঃশব্দ এক শীতের রাতে
মো. সেলিম হাসান দুর্জয়
নলেন গুড়ের গন্ধ বাতাসে। সেই পায়েসের ঘ্রাণ আজও উঁকি দেয় বেলকনির মিহি পর্দা কাঁপিয়ে উদাসী সন্ন্যাসীর বেশে। কয়েক দশকের দীর্ঘ অপেক্ষা! শেষ হবে না নিশ্চিত, হওয়ার নয়, তবুও যেন অপেক্ষাদের অপেক্ষায় মৃত্যুর জন্য প্রহর গোনা। বৈরাগ্য ধূসর ঝরা পাতার রূপমাধুরী রিক্ত টিলার গা ছুঁয়ে ছুটে চলা ট্রেনের বগি অশীতিপর অনিন্দ্য শর্মার তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে বিস্ময় জাগায় শীতের কামুক বাসনা। চা বাগানের মুড়িয়ে যাওয়া বিষণ্ন কুয়াশা থেকে ভেসে আসে ক্ষুধার্ত বিধ্বস্ত শেয়ারের ডাক। ধোঁয়ার মতো উড্ডীন নদীর ও পুকুরের জল অশ্রুসিক্ত করে তাঁর চক্ষু যুগল। সময়! অতি অল্প সময়। কুয়াশার নৌকায় গুন টেনে আজ জীবন সায়াহ্ন! তবুও কীসের আশায় কেটে যায় প্রহর! ঘুমন্ত বয়স ফ্রেমে এখনো তপ্ত দুপুরের সেই মধুক্ষণ কুয়াশার ভেলায় এসে নোঙর ফেলে স্মৃতির ঘাটে।
আজ কীসের টানে স্মৃতির সেই দুর্নিবার জীবন্ত আভা অনিন্দ্যকে ডাকছে। খুব খুব মনে পড়ছে তোমায়! তোমার কি মনে পড়ে? নাকি ভুলে গেছো?
নবান্নের পিঠাপুলির উৎসব তখনও তার শামিয়ানা টাঙিয়ে উৎসব-অনুষ্ঠানে মাতোয়ারা। কৃষাণীর ব্যস্ততা প্রশান্তির সুখ অনুভবে সমুজ্জ্বল। এমনই এক শুভ লগ্নে আকস্মিক জাতীয় পরিবর্তনে ব্যাপক মহাযজ্ঞ। গত ষোল বছরের শাসনের অবসান। গত শাসকের দোসর পরিচয়ে আমাকে বদলি করা হলো। রাজধানী শহর থেকে প্রায় চারশ মাইল দূরে। স্ত্রী সন্তান ফেলে অগত্যা ছুটে চলা। পিছনে ফেলে মায়ার শহর, পরিবার, প্রিয় সন্তান। তবুও দেশটা রক্ষা পাক! আমার বদলি যদি সংস্কারের মহাকাব্য হয় ক্ষতি কি! প্রথম কয়েকদিন স্মৃতি ঘোরে হাতরে বেড়াই ফেলে আসা আক্ষেপ। তারপর চোখ মেলে দেখি এ যে শাপে বর! শহরে ধুলিমাখা চোখে সবুজের মহাসমারোহ। কষ্ট তখনও দগদগে রক্তাক্ত। হঠাৎই তাঁর দেখা। বয়সে আমার কাছাকাছি। গড়নে ষোল কি সতেরো! লাবণ্যে উনিশ কুড়ি। সৌন্দর্যে নিখুঁত প্রতিমা। আচারবোধে বিনয়ের অবতার। তাঁর চওড়া কপালের নাকে আমার সে কি বিস্ময়! হেঁটে চলার ছন্দ-তাল,মনোহারিণী সুরেলা কণ্ঠে যাদুমন্ত্রে প্রোথিত আবেদনময়ী সুর। মুগ্ধ, আমার কল্পনার দেবীকেও হার মানায় তার অপূর্ব মুগ্ধতার ছটা। সমপর্যায়ের অফিসার। প্রথম দেখায় আমাকে আকর্ষণ করতে পেরেছে এমন ইতিহাস নেই। হোক তা বস্তু বা প্রাণ। এই প্রথম কোন প্রাণ আমাকে প্রথম দেখাতেই আকর্ষণ করলো। আকর্ষণ বললে ভুল হবে। মনে হলো হাজার বছরের চেনা। এত চেনা? কোথায় ছিলে? সহস্রবার নিজেকে প্রশ্ন করেছি। প্রত্যুত্তরে শুধু প্রতিধ্বনিত হয়েছে - তোমাকে দেখেছি শতবার শতজনমে, মন্দিরে, আরাধ্যে, মনের গহীনে। তুমি ছিলে, তবুও কোথা ছিলে? তুমি এসেছো আমার কল্পনা আর প্রার্থনার মোনাজাতে। অবশেষে সেই কল্পনা দেবী আমার চোখের আঙিনায় মানবীর বেশে। তারপর হেঁটে চলা দুজনার চোখের পাতায়। মনের আঙিনা ছুঁয়ে অল্পদিনেই দুজনার মনের পরিণয়। একদম নাটকীয় বললেও কম হবে। এভাবে আমার আত্মার কোণে জমে থাকা মানুষটিকে পেয়ে যাব, পাওয়া যায়? পৃথিবীটা সহসাই স্বর্গ হয়ে ধরা দিল আমার কাছে। অতীত মুছে আমরা এগিয়ে চলি নতুনের টানে, হৃদয়ের টানে। সময়টা উড়ছিল ধবধবে বলাকার ডানায়। হাতে হাত রেখে আমরা স্বপ্ন বুনি নানা ক্যানভাসে। উপজেলা শহরটা তখন হয়ে উঠে আমাদের শহর। ব্যস্ত শহর পিছনে ফেলে দূর্বাঘাসে মোড়া ধূলিওড়া মেঠোপথ, কুয়াশার চাদরে আবৃত বিস্তীর্ণ মাঠ, মাতাল হাওয়ার সঙ্গে পাহাড়ি বনফুলের গন্ধ, পাহাড়ের উঁচু উঁচু টিলার ভাঁজে সারি সারি চায়ের বাগান, কু ঝিক ঝিক শব্দে ছুটে চলা ট্রেনের বগি আর রাস উৎসবে মেতে উঠা মানুষের মিতালি। আমি ডুবে যাই তাঁর রূপের সৌকর্যে, বিলীন হই তাঁকে পাওয়ার মহানন্দে। সেও আঁকড়ে ধরে আমার অনিচ্ছার ডাইরিতে ফেলে আসা আক্ষেপের কপাট। কি মায়া! কি আদর! কী অপূর্ব তাঁর ছোঁয়া! তাঁকে না পেলে আমার পুরুষত্ব জানতোই না নারী সে-কি অস্পর্শ, ইন্দ্রজাল, স্বর্গসম।
সামনে শীতকালীন ছুটি। অর্থী রহমানের চোখে-মুখে সে কি উষ্ণতা! পুরো সময় পাশাপাশি ছুঁয়ে থাকার সে কি ব্যাকুলতা! পরিকল্পনা শুরু হলো। শুরু হলো কেনাকাটা। আমি বাড়িতে জানিয়ে দিলাম কাজের ব্যস্ততায় এবার ছুটিতে বাসায় ফেরা সম্ভব নয়, দেশের পরিস্থিতি তো আছেই। তাছাড়া অর্থী চায় না পরিবারের সাথে আমার যোগাযোগ থাকুক। অর্থী চায় না মানে আমার কাছে তা করা অন্যায়,পাপ,মহাপাপ। জানি, সামাজিক কিংবা ধর্মীয় কোনোভাবেই আমি যা করছি তা সংগত নয়, শোভন নয়, অপরাধও বটে। আমার কাছে তেমনটি মনে হয়নি। আমার কাছে মনে হয়েছে অর্থী যাতে কষ্ট পায় তা করা আমার জন্য অধর্ম। অর্থী অল্প, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আমার আরাধ্য হয়ে উঠে। হয়ে উঠে আমার উপাস্য মন্দির। সে হাসলে আমি হাসি। সে কাঁদলে আমি কাঁদি। তার ইচ্ছে পূরণই আমার ধর্ম, আমার পরম শান্তি। বুকের পাঁজর ঘেঁষা আমার প্রথম ছেলে আর চোখের তারায় সদ্য হাঁটতে শেখা মেয়েটি অবলীলায় কুয়াশার মতো উবে যায়! এমন অনুভূতিকে কখনো আমার অবান্তর মনে হয়নি। জানি, এটা অন্যায়,সমাজের চোখে আমি হয়ত পর লোভী বর্বর। নারীলোভী, দেহভোগীও বলতে ছাড়বে না কেউ কেউ। তবুও আমি আমার বিশ্বাসের মন্দিরে অনড়, নিজের আত্মার কাছে স্বতঃসিদ্ধ। বরং ভেবেছি যে হৃদয়ে অর্থীকে রেখেছি সেখানে অন্য কারো স্থান হতে পারে না! এটা অন্যায়, এটা আমার ভালোবাসার কাছে এক মহা অধর্ম। আমার পবিত্র মনের অকৃপণ বন্দনায় অর্থী এক পবিত্র সংবিধান। এর বাইরে যাওয়ার সাধ্যি কি! অর্থীর হাত ধরে আমি এগিয়ে চলি পিছনে ফেলে অতীত মায়া। বন্ধ হয়ে যায় স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ। আত্মীয় স্বজন পরিজন হয়ে উঠে অচেনা শহর। আমার বলতে এখন কেবলই সে। সিদ্ধান্ত হলো আমাদের জীবনের প্রথম শীত আমরা কাটাবো পার্বত্য জেলাগুলোতে। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি হয়ে বান্দরবান। সুবলং ঝর্ণা, পলওয়েল পার্ক,ঝুলন্ত সেতু, কাপ্তাইয়ের জলে অনিন্দ্য-অর্থীর স্বপ্ন, আলুটিলা গুহা, দেবতার পুকুর, তৈদুছড়া ঝর্ণা, নীলাচল,নীলগিরি, শৈলপ্রপাত ঝর্ণা,স্বর্গমন্দির, আঁকাবাঁকা পথে হাতে হাত রেখে ছুটে চলা। সুবলং ঝর্ণার গাঘেঁষা সেতুর উপর দাঁড়িয়ে অর্থী বলেছিলো- অনিন্দ্য, যে হাতে আমায় ছুঁয়েছ, সে হাতে অন্য নারীকে আর ছুঁবে না কোনোদিন । যে বুকে আমাকে রেখে স্বর্গানুভব কুড়িয়েছ সে বুক শাশ্বত কাল আমার অপেক্ষায় থাকুক। আমার যে নারীত্ব সর্বাঙ্গে মেখেছ সে অঙ্গ থাক একক অর্থী বন্দনায়। ভেজা চোখে বলেছিলাম সেদিন - আমার প্রেমদেবীর এ চাওয়া আমৃত্যু আমার পূজার অর্ঘ্য হয়ে থাকবে। এ জনমে তুমি বিনে অন্য ছোঁয়া! প্লিজ, এমনটা মুখেও নিবে না। স্পর্শ তো দূরে থাক, কল্পনার চাদরেও কেউ আসবে না কোনোদিন। অর্থী আদুরে হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আকুল কণ্ঠে অর্থীর প্রার্থনা ছিল ঐ সুবলং ঝর্ণার কাছে- হে সুবলং, আমি আর অনিন্দ্য পাহাড়ের গাঘেঁষা রেললাইন থেকে খানিক দূরে একটা বাড়ি, আমাদের বাড়ি বানাবো। হাতে হাত রেখে শীতের বিকেলে দুজন বসবো বেলকনির উঠোনে। চায়ের কাপে দুজন রচনা করবো আমাদের প্রেমের মহাকাব্য। রাতের অন্ধকার ভেদ করে কুয়াশা এসে ছুঁয়ে দিবে আমাদের। দূর থেকে ভেসে আসবে ক্ষুধার্ত শেয়ালের ডাক। পাহাড়ের পাদদেশে পড়ে থাকা মাধুর্যহীন শুকনো পাতার গা ছোঁয়া ছুটে চলা ট্রেনের শব্দে রাতে হঠাৎ জেগে উঠবো আমি। আদুরে চোখে তখন ঘুমন্ত অনিন্দ্যের মুখে খুঁজে নিব শাশ্বত প্রেমের আশিস। আমি অবাক তাকিয়ে রই অর্থীর মুখে। তাঁর মুখের কল্লোল হাসি দূরের পাহাড়ে প্রতিফলিত হয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে মিশে যায় শূন্যে।
তারপর লাগামহীন পবিত্রতায় দুজনার এগিয়ে চলা। ঘুম ব্যতীত বাকি সময় মোবাইলে কিংবা সরাসরি একসাথে। কেটে যাচ্ছে দিন শুভ্র প্রেমের ডানায়। বছর গড়িয়ে আমাদের সম্পর্কের বয়স তখন দুবছরে পা দিবে দিবে। হঠাৎ অর্থীর মাঝে কিছু পরিবর্তন। আগে অফিসের সমগ্র সময়জুড়ে আমি থাকতাম মোবাইল কানেকশনে। এখন প্রায়ই নানা অজুহাতে কানেকশন বিচ্ছিন্ন থাকতে চায়, থাকে। আগে রাতের দুইটা তিনটার আগে বিছানায় যেত না। এখন দশটা বাজতেই বিছানায় যাওয়ার তোড়জোড়। তাঁর চোখে এখন রাজ্যের ঘুম। আমাকে ঘুমপাড়ানির গল্প শোনায়। তাঁর সাথে দেখা করার বিষয়টা এড়িয়ে যায় খুব শান্তভাবে। আমি বিচলিত হই। অর্থীর এমন পরিবর্তন আমাকে বিস্মিত করে, কুঁকড়ে দেয়। আমি যে আজ অর্থী শূন্য মানে পৃথিবী শূন্য। আমার কোনো আলাদা জগৎ নেই। স্ত্রী সন্তানের সাথে যোগাযোগহীন সেই থেকে। কেবল মাসের প্রথমে সংসারের খরচের টাকা বিকাশ করি। ফাঁপর লাগে। শরীর ঘর্মাক্ত হয় অজানা আশঙ্কায়। ইদানীং আমাকে ভিডিও কলে রেখে অর্থী রূপচর্চায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারপর অসমাপ্ত কথার মাঝে মোবাইল কেটে দেয়। কারণ জিজ্ঞেস করলে রেগে যায়। কথা বলা বন্ধ করে দেয়। আমি বুঝার চেষ্টা করি- হয়ত মানসিক কোন টেনশন চলছে তাঁর। না, দিন দিন আমাদের সম্পর্কের মানচিত্রে অর্থীর অনিয়ম বেড়েই চলে। রাগ অভিমান ঝগড়া এখন নিত্য ঘটনা। কয়েকদিনের রাগ অভিমান শেষে যখন কথা হয়- অর্থীর চোখে-মুখে কোন ক্লান্তি নেই, কষ্ট নেই। প্রতিমার মতো মুখটা আরো ঝলমলে দেখায়। বুঝা যায় স্পষ্ট - আধুনিক প্রসাধনীর ব্যবহার হয়েছে নিত্য। এদিকে খাওয়া দাওয়া, গোসল ছাড়া আমার সে কী হাল! তাতে আজ অর্থীর কিছুই যায় আসে না।
অর্থী রাগতে পারে, এটা ছিল আমার বোধগম্যতার বাইরে। এখন তো অশ্লীল শব্দচয়নে ক্ষতবিক্ষত করে আমাদের সম্পর্কের শামিয়ানা। এভাবে আরো কিছু সময় পেরিয়ে যায় আপন গতিতে। ভিতরে ভিতরে সে কি অসহ্য যন্ত্রণা! আমি অফিসে অমনোযোগী হয়ে পড়ি। নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে যায়। অর্থী এখন রোজ শাড়ি পরে অফিস করে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে সবুজ বাতি জ্বললেও আমার ফোনে নোটিফিকেশন আসে অল্প।
আবার হেমন্ত বিদায় নেয়। শীতের আগমনী শব্দ আমাকে ব্যাকুল করে তুলে। গতবার শীতে অর্থীর হাতে তৈরি পায়েস! আহ! যেন অমৃত। স্বর্গীয় ভোজন। অর্থীর রান্নার হাত অতুলনীয়। সারাদিনের ব্যস্ত দায়িত্ব শেষ করে গভীর রাত অবধি আমার পছন্দের খাবার রান্না করা পরম তৃপ্তি মাখা সেই মায়াবী মুখ। নিজ হাতে খাবারের প্রথম লোকমা আমার মুখে তুলে দেওয়া সেই হাত। বাজারে গিয়ে অগোছালো এই আমার জন্য আড়ং এর প্রিয় টি-শার্ট আর ফতোয়ার বাহারি কালেকশন। অনলাইন থেকে শীতের প্রসাধনী, শ্যাম্পু আর বডি স্প্রে আনিয়ে সাথে সাথে আমাকে ফোন করা সেই কণ্ঠ। আমি ব্যাকুল হয়ে উঠি শীতের আগাম আহ্বানে। শীতের মাঝামাঝি। ছুটি শুরু হবে। হঠাৎ অর্থীর কল- অনিন্দ্য, এবার ছুটির প্রথম রাতেই আমি কলিগদের সাথে খুলনায় ঘুরতে যাব। সপ্তাহখানেক থাকব সেখানে। ওখানে নেট থাকে না, মিনিট কলও করা যায় না। এসে তোমাকে জানাব। তারপর বাপের বাড়ি যাব। ভাইয়া, ভাবী ঢাকা থেকে ফিরবে। সুযোগ হলে ছুটির শেষে এসে একদিন দেখা করে যেও। কল কেটে যায়। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। এই প্রথম আমি কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারছি না। রাত তখন দশটা। হোয়াটসঅ্যাপে অর্থীকে মেসেজ করি -
গত শীতে তোমার চোখের উষ্ণতা ছিলাম শুধুই আমি।এবারও শীত এসেছে। তোমার চোখেও আছে উষ্ণতা। শুধু আমিটা নেই, হয়ত অন্য কেউ তোমার উষ্ণতা জুড়ে। - নিয়তি।
অর্থী কোনো উত্তর করেনি। দশ দিন হয়ে গেছে অর্থী আমাকে কল করেনি। মেসেজ করেনি। আমি নক দিয়েছিলাম। রেসপন্স করেনি। আজ সেই দিন। অর্থী তাঁর কলিগদের সাথে ঘুরতে যাবে। আমি আবার মেসেজ করলাম-
অর্থী, আমি দুটি টিকেট কেটে রেখেছি। আমি রেলওয়ে স্টেশনে অপেক্ষা করব। আমাদের ট্রেন ছাড়বে সাড়ে বারোটায়। তুমি আসবে, তোমার অপেক্ষায় রইলাম।
অর্থী কোনো উত্তর করেনি। বারোটায় অর্থীর কল এলো- আমি বাসে আছি। আমাদের বাস এখন ছাড়বে। পাশ থেকে কেউ একজন বলছে- মোবাইল রাখতো। কল কেটে যায়।
সারা রাত স্টেশনে বসে থাকি। তারপর পেরিয়ে গেছে চল্লিশ বছর। আয়ুর খেলায় এখনো বেঁচে আছি। রাধা, আমার সন্তানের মা। তাঁকে মেসেজ করেছিলাম সব জানিয়ে - আমার আর ঘরে ফেরা হবে না। পারলে সন্তানদের মতো তুমিও আমাকে ক্ষমা করে দিও। রাধা আমার কথা মেনে নিয়েছিল বিনা বাক্যে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা রাধা কোনোদিন আমাকে প্রশ্ন করেনি। সেই যে ঘর ছাড়লাম, শহর ছাড়লাম, আজও ফেরা হয়নি। কালেভদ্রে মেয়েটা এসে আমাকে দেখে যায়। সে আজ মস্ত অফিসার। ছেলেটা আজও দেখতে আসেনি। মেয়েটা ছবি দেখাতে চেয়েছে। দেখতে ইচ্ছে হয়নি। পাহাড়ের পাদদেশে জমি কেনা হলো, বাড়ি হলো, রোজ ট্রেনের শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। বেলকনির পর্দা ভেদ করে শেয়ালের আর্তনাদ কানে বাজে। আজও শীত এলে আমি পায়েসের গন্ধ পাই। আমি আজও অপেক্ষার প্রহর গুনি। নিশ্চিত অনিশ্চিত অপেক্ষার প্রহর।