লভ্যাংশ দিতে সবচেয়ে ভালো করেছে ডাচ্-বাংলা ও উত্তরা ব্যাংক, বিপরীতে রয়েছে আইসিবি ইসলামিক, ন্যাশনাল ও রূপালী
বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণ। ঠিকমতো রাখা হচ্ছে না প্রভিশন। বাড়ছে ব্যাংক খাতে ঝুঁকির মাত্রা। এমন নানান সমালোচনার মধ্যে ২০২৩ সালের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো। সাতটি ব্যাংকের লভ্যাংশের হার আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। বিপরীতে ছয়টি ব্যাংকের লভ্যাংশের পরিমাণ কমেছে। বাকি ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশ রয়েছে অপরিবর্তিত। এ হিসাবে ব্যাংকগুলো অনেকটাই ধারাবাহিকতা রক্ষার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে বলা যায়।
লভ্যাংশের হার কমে যাওয়া ছয় ব্যাংকের মধ্যে তিনটির নগদ লভ্যাংশ আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে। আর দুটির নগদ লভ্যাংশ রয়েছে আগের বছরের সমান। এ হিসাবে, এ ব্যাংকগুলোর নগদ লভ্যাংশের পরিমাণ কমেনি, কমেছে বোনাস লভ্যাংশ। তবে একটি ব্যাংকের নগদ লভ্যাংশ আগের বছরের তুলনায় কমেছে।
ব্যাংকটির লভ্যাংশ শুধু গত বছরের তুলনায় বাড়েনি। গত পাঁচ বছরের মধ্যে ব্যাংকটি এবার সর্বোচ্চ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ২০২১ সালে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের সাড়ে ১৭ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০২০ সালে ১৫ শতাংশ নগদ ও ১৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার এবং ২০১৯ সালে ১৫ শতাংশ নগদ ও ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়।
সর্বোচ্চ লভ্যাংশের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে উত্তরা ব্যাংক। এই প্রতিষ্ঠানটিও গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ব্যাংকটি ২০২৩ সালের জন্য সাড়ে ১৭ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর আগে ২০২২ ও ২০২১ সালে ১৪ শতাংশ নগদ ও ১৪ শতাংশ বোনাস শেয়ার, ২০২০ সালে সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস শেয়ার এবং ২০১৯ সালে ৭ শতাংশ নগদ ও ২৩ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়।
এদিকে সমস্যায় পতিত হওয়া আইসিবি ইসলামী ব্যাংক বরাবরের মতো এবারও বিনিয়োগকারীদের কোনো ধরনের লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লভ্যাংশ না দেওয়ার এ তালিকায় রয়েছে নতুন করে সমস্যায় পড়া ন্যাশনাল ব্যাংক। রাষ্ট্রীয় মালিকাধীন রূপালী ব্যাংকও বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রূপালী ব্যাংক ২০২২ সালেও বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। এর আগে ২০২১ সালে ২ শতাংশ ও ২০২০ সালে ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। ন্যাশনাল ব্যাংক ২০২২ ও ২০২১ সালেও বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। তার আগে ২০২০ সালে ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার এবং ২০১৯ সালে ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়। আর আইসিবি ইসলামী ব্যাংক সর্বশেষ কবে লভ্যাংশ দিয়েছে, সে সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি।
আগের বছরের তুলনায় লভ্যাংশ কমার তালিকায় রয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ঢাকা ব্যাংক, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক এবং শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক। এরমধ্যে সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের নগদ লভ্যাংশের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় কমেছে। বিপরীতে মোট লভ্যাংশের পরিমাণ কমলেও এনআরবিসি, ঢাকা ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের নগদ লভ্যাংশের পরিমাণ গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। বাকি দুটি ব্যাংকের নগদ লভ্যাংশের পরিমাণ অপরিবর্তিত রয়েছে।
লভ্যাংশের হার অপরিবর্তি থাকা ব্যাংকগুলোর মধ্যে এবি ব্যাংক আগের বছরের মতো ২০২৩ সালের জন্যও ২ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক ১০ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। আগের বছর ব্যাংকটি ১২ শতাংশ নগদ ও ৩ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০২১ ও ২০২০ সালে ১৫ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৯ সালে ব্যাংকটি ১৩ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়।
ব্যাংক এশিয়া গত বছরের মতো এবারও ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিচ্ছে। ২০২১ সালেও ব্যাংকটি ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়। তার আগে ২০২০ ও ২০১৯ সালে ১০ শতাংশ করে নগদ লভ্যাংশ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। ইস্টার্ন ব্যাংক ২০২২ সালের মতো ২০২৩ সালেও সাড়ে ১২ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ১২ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ দিয়েছে। ২০২১ সালেও একই লভ্যাংশ দেয় প্রতিষ্ঠানটি। তার আগে ২০২০ সালে সাড়ে ১৭ শতাংশ নগদ ও সাড়ে ১৭ শতাংশ বোনাস এবং ২০১৯ সালে ১৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়।
চলতি বছর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া এনআরবি ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ২০২৩ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া মিডল্যান্ড ব্যাংক আগের বছরের মতো এবারও ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ২০২২ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক আগের বছরের ধারাবাহিকতায় ৫ শতাংশ নগদ ও ৫ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। ২০২২ সালে তালিকাভুক্ত হওয়া আরেক প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন ব্যাংকও আগের বছরের ধারাবাহিকতায় ৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে।
এদিকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকায়। ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকার মধ্যেই তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর এই লভ্যাংশের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, কয়েকটি ব্যাংক ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছে। ব্যাংক খাতে কিছুটা সংকট আছে। সবচেয়ে বড় সন্দেহ হচ্ছে তারা প্রভিশন ঠিকমতো করে কি না। যে ব্যাংকগুলো ভালো, তারা তো ভালো করছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতের লভ্যাংশকে সন্তোষজনক বলা যায় কি না? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, মোটামুটি। আমার মনে হয় ব্যাংকের খেলাপি ঋণ খুব বেশি। এই খেলাপি ঋণ ঠিক করতে গেলে একটা সমস্যা দেখা দেবে। ব্যাংক খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো দেখাচ্ছে, প্রকৃত খেলাপি ঋণ এর দ্বিগুণেরও বেশি। এটা সাধারণ মানুষের ধারণা।
অন্যদিকে বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সাবেক সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, আমাদের বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকের শেয়ার কেনে না। যার কারণে ব্যাংকের শেয়ার প্রায় একই জায়গায় থাকে। লভ্যাংশের দিক থেকে বিবেচনা করলে ব্যাংকের লভ্যাংশ খুবই ভালো। আমাদের এখানে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগকারী নেই, লভ্যাংশের জন্য কেউ বিনিয়োগ করে না। অনেক ব্যাংকের ডিভিডেন্ড ইল্ড (রিটার্ন) এফডিআর রেট থেকে বেশি।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে একটা খারাপ সংস্কৃতি সবাই দ্রুত ক্যাপিটাল গেইন চায়। যার কারণে পচা শেয়ারের পেছনে মানুষ দৌড়ায়। ব্যাংকগুলোকে যত খারাপই বলুক, বাংলাদেশ ব্যাংক নজরদারি করার পরেই ব্যাংকগুলোর লভ্যাংশের সিদ্ধান্ত আসে। তার মানে তাদের সক্ষমতার কারণেই লভ্যাংশের অনুমতি পায়।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ডিবিএ) সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, কিছু ব্যাংক খুবই ভালো লভ্যাংশ দেয়। সেটা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। কিছু ব্যাংক দিতে পারেনি, আমার ধারাণা ওদের প্রভিশন রাখার কারণেই দিতে পারেনি। ব্যাংকের গভর্ন্যান্স ভালো হলে ব্যাংক ভালো হবেই।
তিনি বলেন, লভ্যাংশের হার কম দেওয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে আবার নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার পরিমাণ কমেনি। এটা ভালো দিক। বোনাস শেয়ার দেওয়া বা না দেওয়ার ভেতরে খুব বড় পার্থক্য নেই। কারণ হচ্ছে বোনাস দিলে টাকা ব্যালেন্স শিটে থাকে, না দিলেও ব্যালেন্স শিটে থাকে। ক্যাশটা বিতরণ করা হয়। যদি ক্যাশটা ঠিক থাকে বা বেশ হয়, তাহলে বুঝতে হবে, ওই প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্য ভালো। ক্যাশ যদি না থাকে, তাহলে ক্যাশ ডিভিডেন্ড দেওয়া যায় না। সেদিক থেকে ব্যাংকের লভ্যাংশ আমরা ভালো দেখতে পারছি।