
বিশ্বের বৃহত্তম বদ্বীপ বাংলাদেশ। উপরিতলের বাংলাদেশ সমতল ভূমি হলে টেকটোনিক প্লেট হিসেবে বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মোট তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত শস্য-শ্যামল সমতল ভূমিটি। রয়েছে একাধিক ফল্টও। এসব কারণে বাংলাদেশকে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ বাস্তবতায় চলতি সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরপর তিন ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, যা জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।
#তিনটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থান বাংলাদেশের
#বাংলাদেশ ও সীমান্তবর্তী এলাকায় একাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ফল্ট
#ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রয়োজন প্লেটের মুভমেন্ট ডাটা
#দেশে গবেষণার পর্যাপ্ত প্রযুক্তি ও অবকাঠামো নেই
বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান সময়ে ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের মধুপুর ফল্ট, ডাউকি ফল্ট এবং চট্রগ্রামের টেকটোনিক মুভমেন্টের কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৭.৫ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনা রয়েছে। সাম্প্রতিক ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ধরনের বিপর্যয়ের পূর্বাভাসও হতে পারে।
ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দেওয়া বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জন্য অনেকটাই অসম্ভব। তবে প্লেট মুভমেন্টের ওপর ভিত্তি করে ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব। তবে ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ হলেও বাংলাদেশে এ বিষয়ে গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহের অবকাঠামো খুবই সীমিত। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করছেন যে, প্লেটগুলোর মুভমেন্ট পর্যবেক্ষণ না করলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা বহু গুণ বাড়বে। যদিও এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা, উন্নত অবকাঠামো এবং সঠিক পরিকল্পনা।
টেকটোনিক প্লেট, ফল্ট ও বাংলাদেশ
বাংলাদেশ তিনটি টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। এই প্লেটগুলোর একটি হলো ভারতীয় প্লেট। যা দক্ষিণ এশিয়ার বিশাল অংশ জুড়ে অবস্থিত। এটি উত্তর দিকে ইউরেশীয় প্লেটের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে হিমালয় পর্বতমালা গঠিত হয়েছে। আর ইউরেশীয় প্লেট বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী অংশে অবস্থিত। এই প্লেটের প্রভাব তুলনামূলক কম হলেও উত্তর দিকে ভারতীয় প্লেটের সঙ্গে এর মিথস্ক্রিয়ার ফলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি হয়। বার্মা মাইক্রোপ্লেট মিয়ানমারের কাছে অবস্থিত। যা সুমাত্রা-আন্দামান অঞ্চল থেকে শুরু হয়ে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে ভূমিকম্পের জন্য অন্যতম প্রধান কারণ।
এছাড়া বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ফল্ট লাইন রয়েছে। যেমন মধুপুর ফল্ট, ডাউকি ফল্ট, এবং চট্টগ্রামের টেকটোনিক মুভমেন্ট অঞ্চল, যা ভূমিকম্পের সক্রিয় এলাকা। ডাউকি ফল্ট একটি সি-প্লেট যা ভারতের নর্থ ইস্ট অংশ এবং বাংলাদেশের মেঘালয় রাজ্য অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত। এটি বিশেষভাবে গৌহাটি থেকে শুরু হয়ে মেঘালয় এবং বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে বিস্তৃত হয়ে চলেছে। ডাউকি ফল্টের ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং অবস্থান বাংলাদেশে ভূমিকম্পের জন্য একটি সম্ভাব্য ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত।
সাম্প্রতিক ভূমিকম্প ও ইতিহাস
গত ৫০ বছরে (১৯৭৫-২০২৫) বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। তবে, সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন, কারণ ছোট মাত্রার ভূমিকম্পগুলো প্রায়শই নথিভুক্ত হয় না। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশেই ছিল। ২০২৩ সালের ২ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলায় ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ২২ নভেম্বর চট্টগ্রামে ৬ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল, যা শহরের নানা স্থাপনায় ফাটল ধরায়।
চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশের পরপর তিনটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। প্রথম ভূমিকম্পটি ৩ জানুয়ারি রাত ১১টা ৫ মিনিটে অনুভূত হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল ভারতের আসাম এলাকায়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৫.২ এবং গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার। এর পরদিন, ৪ জানুয়ারি সকাল ৭টা ২৮ মিনিটে দ্বিতীয় ভূমিকম্পটি ঘটে। এটি রিখটার স্কেলে ৪.৮ মাত্রার ছিল এবং উৎপত্তিস্থল ছিল মিয়ানমারের চীন সীমান্তের কাছে। সর্বশেষ ৭ জানুয়ারি সকাল ৭টা ৫ মিনিটে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে শক্তিশালী ভূমিকম্প অনুভূত হয়। ভূমিকম্পটির কেন্দ্রস্থল ছিল চীনের জিজাং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে (তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল), যা ঢাকা থেকে প্রায় ৬১৮ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৭.১ এবং উৎপত্তিস্থলের গভীরতা ছিল ১০ কিলোমিটার।
এ অঞ্চলের ইতিহাসেও বড় ধরনের ভূমিকম্পের অস্তিত্ব রয়েছে। ১৮৯৭ সালের শিলং প্লেটের ভূমিকম্প তার মধ্যে অন্যতম। মেঘালয়ে উৎপন্ন ৮ দশমিক ৪ মাত্রার এই ভূমিকম্প ঢাকাসহ দেশের বিশাল এলাকায় প্রভাব ফেলেছিল। এর আগে ১৮৮৫ সালের মধুপুর ফল্টের ৭ মাত্রার বেশি শক্তিশালী একটি ভূমিকম্প হয়। যা বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকায় তাণ্ডব চালায়। এছাড়া ১৯১৮ সালের সিলেটেও একটি বড় ভূমিকম্প হয়। বর্তমান সময়ে ভূমিকম্পের ঝুঁকি আরও বেড়েছে। দেশের মধুপুর ফল্ট, ডাউকি ফল্ট এবং চট্টগ্রামের টেকটোনিক মুভমেন্টের কারণে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৭.৫ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়েও একাধিক ভূমিকম্প অনুভব করেছে বাংলাদেশ। যদিও এর উৎপত্তিস্থল বাংলাদেশে না। কিন্তু আশেপাশে বড় ধরনের ভূমিকম্প দেশে বড় ক্ষয়ক্ষতির কারণ হতে পারে। ধারণা করা হয়, ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে পুরান ঢাকার ৬০-৭০ শতাংশ ভবন ধ্বংস হয়ে যাবে। পুরোনো ভবনের পাশাপাশি অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দুর্বল অবকাঠামো পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। আর বার্মাতে ৭ বা ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে তা ভয়াবহ ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। তবে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা এবং মডেল না থাকার কারণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ পূর্বেই নির্ধারণ কারা কঠিন।
ছোট ভূমিকম্প, বড় দুর্যোগের পূর্বাভাস নাকি ঝুঁকি হ্রাসের উপায়?
সাম্প্রতিক একাধিক কম্পনে বাংলাদেশে ভূমিকম্প আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে এসব ছোট ছোট কম্পন বড় কম্পনের পূর্বাভাস কিনা তা নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। এ নিয়ে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদফতরের (জিএসবি) দূর অনুধাবন ও জিআইএস শাখার পরিচালক (ভূতত্ত্ব) সৈয়দ নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেয়। আবার এনার্জিও রিলিজ করে। এটি হলে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমে। তবে ছোট ছোট ভূমিকম্প যদি মাঝে মাঝেই হয় তাহলে তা বড় ভূমিকম্পের বার্তা দিচ্ছে বলা যায়। এর মানে প্লেটগুলো তার অবস্থান অ্যাডজাস্ট করছে। ফলে হঠাৎ করে বড় ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
তিনি আরও বলেন, অনেকে ধারণা করছেন বাংলাদেশে থাকা প্লেট ও ফল্টগুলো থেকে ৭.৫ থেকে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। কিন্তু কোনো গবেষণা ছাড়া এটা সুনিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব না। এটার জন্য দীর্ঘমেয়াদে সংগৃহীত ডাটা ও গবেষণা প্রয়োজন। কিন্তু ঝুঁকি স্টাডি করার জন্য যে অবকাঠামো প্রয়োজন তা আমাদের দেশে নেই। তবে এটা বলা যায় বাংলাদেশ কিছুটা ঝুঁকিতে রয়েছে।
ভূমিকম্প হলে তা কত মাত্রার হতে পারে?
এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ভূমিকম্পের মাত্রা যত বেশি হবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ততো বেশি হবে। এখন এমন কোনো তথ্য নেই বা বলার সুযোগ নেই যে, ঢাকায় ‘এত’ মাত্রার ভূমিকম্প হবে। যত বেশি মাত্রার হবে ততো বেশি ক্ষতি হবে। যেমন সাত মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার পুরাতন ভবনগুলো একটাও থাকবে না। বলা হয়ে থাকে ৬০-৭০ শতাংশ ভবন ভেঙে যাবে। কিন্তু এটা নতুন ঢাকার নয়, শহরের পুরাতন অংশটা।
ভূতত্ত্ব জরিপ অধিদফতর সঠিক ধারণা দিতে চায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ছোট মাত্রার যে ভূমিকম্পগুলো হয়েছে সেগুলো গভীরতা ১০ কিলোমিটার। ভূমিকম্প ঘটে প্লেট বাউন্ডারিতে। যখন একটা প্লেটের সাথে অপর একটা প্লেটের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় তখন দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চয় করা শক্তি নিঃসরণ করতে চায়। যখনই রিলিজ করে তখনই ভূমিকম্প হয়। যত দীর্ঘদিন বাউন্ডারি মুভমেন্টে থাকবে তখন ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা সবথেকে প্রবল। বাংলাদেশ যে প্লেটগুলোর উপর সে নিশ্চিতভাবে মুভমেন্টের মধ্যে রয়েছে। এই মুভমেন্টটা স্টাডি করার জন্যই আমরা অবকাঠামো চাচ্ছি।
তিনি বলেন, বার্মা প্লেটের কথা যদি ধরি, বাংলাদেশ সে প্লেটের বাউন্ডারির সামনের দিকে। ফলে বার্মাতে যদি ভূমিকম্প হয়, বাংলাদেশে তার প্রভাব পড়বে। এ বিষয়গুলো স্টাডি করা দরকার যে, বার্মাতে ৭ বা ৮ মাত্রার একটা ভূমিকম্প হলে বাংলাদেশে কতটা ক্ষতি হবে। সে বিষয়ে কারো কোনো সুস্পষ্ট ধারণা নেই। জিএসবি এটি করা চেষ্টা করছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমরা অবকাঠামো তৈরি, জিপিএস স্থাপন করার চেষ্টা করছি। যেন ভবিষ্যতে এ বিষয়ে স্টাডি করা যায়। আমরা এ বিষয়ে একটা মডেল তৈরি করতে চাই। যেন মানুষকে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারি।
করণীয় কি?
ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ভূমিকম্প হলে ক্ষতি নিশ্চিত। এক্ষেত্রে আমরা ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারি। এর মধ্যে অন্যতম ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা এলাকায় ভূকম্পন সহনশীল ভবন তৈরি করা। জনসচেতনতা তৈরি করা, অর্থাৎ ভূমিকম্প হলে করণীয় কী তা তাদের জানানো। সচেতনতার অংশ হিসেবে বেশি পুরাতন হলে ভবন ভেঙে ফেলা যেতে পারে। তার জায়গায় ভূমিকম্প সহনীয় ভবন তৈরি করতে হবে। কিছু ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা যায়। এছাড়া ভবন নীতিমালা ঠিকঠাক অনুসরণ করতে হবে। এজন্য সবথেকে বেশি প্রয়োজন গবেষণা এবং সার্বক্ষণিক ডাটা। যেন আমাদের কাছে তথ্য থাকে এবং আমরা তা মানুষকে জানাতে পারি।
তিনি বলেন, ভূমিকম্প পরবর্তী ব্যবস্থাপনা ও উদ্ধার অভিযান ফায়ার সার্ভিসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো করে থাকে। আমাদের সাথে তাদের আলোচনা হয়, আমরা তাদের পরামর্শ দেই। যদিও ভূমিকম্পের বিষয়ে পূর্বাভাস দেওয়া যায় না। হয়তো ভবিষ্যতে এটি দেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। তবে বর্তমানে এমন কিছু নেই।